আয়না মানুষ By Biswadip Dey

আয়না

read আয়না মানুষ

সপ্তর্ষি প্রকাশন থেকে প্রকাশিত বিশ্বদীপ দে-র বই আয়না মানুষ। এটি দশটি গল্পের সংকলন এবং প্রতি গল্পের বিষয়বস্তু একে অন্যের থেকে সম্পুর্ন্য ভিন্ন। গল্পগুলিতে যেমন আছে বৈচিত্র্যের ছোঁয়া তেমনি ভাবনার খোরাক। চেনাজানা মানুষজন , রোজকার ঘটনা লেখকের লেখনীর জাদুকাঠিতে হয়ে উঠেছে আরও প্রানবন্ত। আয়না মানুষ

কেন জানি না, এই বইটা নিয়ে লিখতে গিয়ে চোখের সামনে শুধু কালীপুজোর রাত, আর তুবড়ি-‘ইলেকট্রিক তার’-রংমশালের কথা মনে পড়ছে।

বিশ্বদীপের গল্পের সঙ্গে যদি আপনাদের আগে পরিচয় থেকে থাকে, তাহলে আপনারা বুঝবেন, কেন আমার এমনটা মনে হচ্ছে। আর যদি আমার মতো আপনাদেরও এটাই হয় ‘ফার্স্ট কনট্যাক্ট’, তাহলে হে পাঠক, প্রস্তুত হোন গল্পের এমন এক প্রদর্শনী দেখার জন্যে যা আপনার চোখ-মন-ভুবন ধাঁধিয়ে তো দেবেই, সব আলো নিভে যাওয়ার পরেও যার রোশনাই-এর রেশ আপনার চোখের পর্দায় আঁকিবুকি কেটে চলবে, এমনকি ঘুমের গভীরেও।

এই বইটা পড়ার আগে বিশ্বদীপের লেখার সঙ্গে আমার একমাত্র পরিচয়ের সূত্র ছিল ‘দুকূল’ পত্রিকায় প্রকাশিত একটি বিজ্ঞান-বিষয়ক প্রবন্ধ। তারপর, এই বইটা পড়ে, আমি আক্ষরিক অর্থে স্তম্ভিত হয়েছি এটা ভেবে যে আমাদের নজরের আড়ালে এমন এক গল্পকার লুকিয়ে ছিলেন! শুধু প্লটের অভিনবত্ব নয়, নয় শুধু ভাষার কারিকুরি, বরং প্রায় থ্রিলারের পরিমিতিবোধ আর একান্ত বাস্তব চরিত্রায়ন: এই দুয়ের সমন্বয়ে এই গল্পগুলো হয়ে উঠেছে দেদীপ্যমান রত্নতুল্য।

যেসব গল্প আছে এই বইয়ে তারা হল:
১. ওয়ান শটার
২. সমুদ্রবীজ
৩. তারার তিমির
৪. গুপ্তধন
৫. আয়না মানুষ
৬. আটলান্টিস
৭. শেষ চিঠি
৮. শিখণ্ডী-স্থূণাকর্ণ সংবাদ
৯. কথোপকথন
১০. দৃশ্যের জন্ম
এর মধ্যে একটি গল্প পৌরাণিক, কিন্তু তার মূল সংকট যে বিষয় নিয়ে, তা চিরন্তন। শেষ গল্পটি গল্পের একরৈখিক চরিত্র ভেঙে বরং দৃশ্যের পর দৃশ্য তুলে ধরে গল্পকে নিয়ে গেছে তার নির্মম পরিণতির দিকে। কিন্তু গল্পগুলো পড়লে একটাই কথা মনে হয়।

এই সময়, তার বিপুল সমুদ্রে মথিত হয়ে চলা অজস্র ছোটো-বড়ো চরিত্র, তাদের ক্ষুধা-হাহাকার-ব্যর্থতা-সাফল্য-ক্লান্তি, তাদের যৌনতা, তাদের লোভ: এরাই আসলে মানুষের আকার নিয়ে আমাদের চেনাজানা মানুষদের মতো ভাষায় কথা বলেছে, রংরূপ নিয়েছে, এই গল্পগুলোয়।

কিছুই কি ত্রুটি নেই এই গল্পগুলোয়? আছে, কিন্তু আমি সেই নিয়ে গজগজ করব না, কারণ গল্পের সন্ধানে বেরিয়ে পড়া অজস্র পাঠকের মতো আমিও যখন হঠাৎই সন্ধান পেয়েছি এমন এক গল্পকারের, তখন আমি সব পাঠককে অনুরোধ করব এই বইটা পড়তে, এবং লেখককে মতামত জানাতে।

এমন একজন দক্ষ কাহিনিকার ‘ওয়ান শটার’ হয়ে থেমে যান, সেটা নিশ্চয়ই আমরা কেউই চাই না, তাই না? 90 শেষ করলাম এবারের বইমেলায় (২০১৬) সপ্তর্ষি প্রকাশন থেকে প্রকাশিত বিশ্বদীপ দে-র বই আয়না মানুষ ।
এটি দশটি গল্পের সংকলন এবং প্রতি গল্পের বিষয়বস্তু একে অন্যের থেকে সম্পুর্ন্য ভিন্ন। গল্পগুলিতে যেমন আছে বৈচিত্র্যের ছোঁয়া তেমনি ভাবনার খোরাক। চেনাজানা মানুষজন , রোজকার ঘটনা লেখকের লেখনীর জাদুকাঠিতে হয়ে উঠেছে আরও প্রানবন্ত।

বইয়ের গল্পগুলির মধ্যে আমাকে বিশেষ ভাবে মুগ্ধ করেছে শিখন্ডি-স্থুনাকর্ণ সংবাদ, সমুদ্রবীজ, আয়না মানুষ, এবং শেষ চিঠি।

শিখন্ডি-স্থুনাকর্ণ সংবাদ গল্পে লেখক লিঙ্গান্তর এর মতন স্পর্শকাতর বিষয়বস্তুকে মহাভারতের একটি কাহিনীর মোড়কে দুর্দান্তভাবে পাঠকদের কাছে শুধু তুলেই ধরেননি সাথে রেখেছেন একটি নির্মম দর্শন। লেখকের ভাষায় - লিঙ্গান্তর যেন ধর্মান্তরিত হওয়ার মতন, কিংবা তার থেকেও ভয়াবহ কোনো ঘটনা। আমার মনে হয় যুগের পর যুগ বদলে গেলেও, এ নিয়ে মানুষের মনোভাব বদলাবে না।

সমুদ্রবীজ গল্পে তৃনা এবং অতনু সদ্যবিবাহিত দুই তরুণ-তরুণী তাদের মধুচন্দ্রিমা কাটাতে এসে হাজির হয় নিউ দিঘাতে, সেখানে তাদের আলাপ হয় ষাট বছরের এক বৃদ্ধ মহিলার সাথে। তৃনার সাথে খুব সহজেই তার আলাপ জমে ওঠে এবং কথা প্রসঙ্গে সে জানতে পারে বৃদ্ধার এক পুত্র সন্তান দিঘাতে বন্ধুদের সাথে বেড়াতে এসে চিরকালের মতন তলিয়ে গেছে সমুদ্রের বুকে। সেই ছেলের টানেই বার বার ফিরে আসেন বৃদ্ধ দম্পতি এই সমুদ্রের কাছে। এই কাহিনী তৃণার মনকে ভারাক্রান্ত করে তোলে , তার মনে পরে যায় তার জীবনের গোপন অতীতের কথা , যা সে কখনো বলে উঠতে পারেনি অতনুকে। এই অতীত ঘটনাই গল্পের শেষে দুই নারী চরিত্রকে বেঁধে ফেলে এক সুতোয়, তাদের জীবন যন্ত্রণা মিশে যায় সমুদ্রের ঢেউয়ে। গল্পটি ভীষণভাবে মনকে ছুঁয়ে যায় , যার রেশ পড়ার অনেকক্ষণ পরও থেকে যায়।

আয়না মানুষ গল্পে সাধারণ মধ্যবিত্ত জীবনযাপনে অভ্যস্ত অঞ্জনের পৃথিবী একমুহুর্তে বদলে যায় যখন সে জানতে পারে তার চেহারার সাথে মিল আছে সদ্য প্রয়াত জাতীয় পুরস্কার বিজয়ী অভিনেতা সুমন্ত সেনের। দুজন দুটো আলাদা মানুষ শুধু দেখতে অনেকটা একরকম ; শুধুমাত্র এই মিল থাকার সুবাদে তাকে ব্যবহার করে সুমন্তর একটি অসমাপ্ত ছবির কাজ সম্পূর্ণ করতে চান বিখ্যাত পরিচালক আশিস নন্দী। অঞ্জনের জীবনে শুরু হয় এক অদ্ভূত টানাপড়েন ; কখনো তার মনে হয় এই মিলটা তার জীবনে একটা অভিশাপ আবার কখনো মনে হয় এ এক চরম পাওনা।

শেষ চিঠি গল্পে বইপাগল বিজন কলেজ স্ট্রিট থেকে কেনা একটি পুরোনো পত্রিকার মধ্যে খুঁজে পায় একটি চিঠি , যা আজ থেকে পঁচিশ বছর আগে লেখা। এই চিঠিটি লিখেছেন কোনো এক জ��ৈকা লেখিকা অসমবয়সী পিউকে। চিঠিটিতে কোনো ঠিকানা লেখা নেই তাই প্রাপকের বা প্রেরকের সন্ধান পাওয়া দুষ্কর কাজ , চিঠিটি পড়ে বিজন উপলব্ধি করে তার জীবনের কাহিনিও যেন এই পোস্ট না হওয়া চিঠিটির মতন। অনেক কাল ধরে শরীরের ভিতর জমে থাকা কথাগুলো ধাক্কা মারতে থাকে বিজনকে। এই গল্পের শেষটা খুব সুন্দর যা পড়ে যেকোনো পাঠক মুগ্ধ হবেন।

তারার তিমির গল্পটার প্লট ভাবনা অসাধারণ, কলকাতার রাতের অন্ধকারে রুপোলি জগতের দুই বিখ্যাত তারকার (শাহরুখ এবং মাধুরী) ব্যক্তিগত কথোপকথন এবং ভোরের আলো ফোটার সাথে সাথে তাদের নির্দিষ্ট গন্তব্যে ফিরে যাওয়া। গল্পের শেষটা বেশ চমকপ্রদ।

আটলান্টিস গল্পটি স্বগোক্তি ঢংএ লেখা, এই গল্পের শেষে নায়িকা নিজের শরীরের মধ্যে আবিষ্কার করে হীরক খন্ডের সেই দ্যুতি যেই সৌন্দর্য্যকে উপভোগ করার ক্ষমতা শুধুমাত্র চিত্রশিল্পী দীপঙ্করের আছে , শরীরভোগী ক্ষুধাতুর স্বামী রূপকের নেই।

এছাড়াও ভালোলাগা গল্পগুলি হলো গুপ্তধন ; ওয়ান শটার ; কথোপকথন দৃশ্যের জন্ম . প্রতিটি গল্পে ভাষার ব্যবহার আমাকে মুগ্ধ করছে। 90